সময়টা তখন প্রায় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে। রাজ্যের এক সন্ন্যাসী গুরুতর অপরাধের কারণে রাজার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারের সিদ্ধন্ত ছিল স্পষ্ট - মৃত্যুদণ্ড!!! কিন্তু মৃত্যুর আগে সন্ন্যাসী এক অনুরোধ করলেন। তিনি বললেন, “আমাকে মাত্র এক রাত সময় দিন, আমি পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান একত্র করে একটি বিশাল পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দেখাবো।”
রাজার চোখে ঝলক এলো, অবাক হলেও তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এই এক সুযোগ দেওয়ার। তবে সময়সীমা কঠোর - শুধুই এক রাত। সন্ন্যাসী সেই শর্ত মেনে নিলেন। সেই রাতেই শুরু হলো এক অলৌকিক যাত্রা, যেখানে তিনি লেখার কাজ শুরু করলেন, যেন তার জীবন ও আত্মা ওই পাণ্ডুলিপির ওপর নির্ভর করছে
গভীর রাত। অন্ধকার কারাগারে সন্ন্যাসী একটানা লিখেই চলেছেন। বাইরে শেষ প্রহরের ঘণ্টা বাজছে, ভোর হলে তার শিরশ্ছেদ। পাতার পর পাতা পূর্ণ হচ্ছে, তবুও বই শেষের নাম নেই। আতঙ্কে তার হাত কাঁপছে।
হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। এক রাতে এই বিশাল পাণ্ডুলিপি শেষ করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। শেষ আশায় তিনি গোপন মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন । হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় সব আলো নিভে গেলো। অন্ধকারে উদ্ভাসিত হলো এক বিকট ছায়ামূর্তি।
স্বয়ং শয়তানের পুত্র লুসিফার!!!!
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সন্ন্যাসী তার কাছে প্রার্থনা করলেন ভোরের আগে বইটি শেষ করে দিতে। লুসিফার রাজি হলো, কিন্তু শর্ত রাখল - বইটির বিনিময় মূল্য হবে তার আত্মা!! অসহায় সন্ন্যাসী মাথা নাড়লেন। কালির সাথে মিশে গেল তার অশ্রু। শয়তানের হাসি ছিঁড়ে ফেলল সে রাতের নীরবতা।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সন্ন্যাসী তার কাছে প্রার্থনা করলেন ভোরের আগে বইটি শেষ করে দিতে। লুসিফার রাজি হলো, কিন্তু শর্ত রাখল - বইটির বিনিময় মূল্য হবে তার আত্মা!! অসহায় সন্ন্যাসী মাথা নাড়লেন। কালির সাথে মিশে গেল তার অশ্রু। শয়তানের হাসি ছিঁড়ে ফেলল সে রাতের নীরবতা।
শয়তানের বাইবেল’ নামে পরিচিত বিখ্যাত পাণ্ডুলিপি ‘কোডেক্স গিগাস’ নিয়ে এমনই গল্প প্রচলিত আছে সেই ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে!
কোডেক্স গিগাস কি?
‘কোডেক্স গিগাস’ মানে ‘বিশাল বই’। নাম থেকেই বুঝা যায়, বইটি কত বড় আর ভারি! এই বইটা গাধার চামড়া ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। এতে মোট ৩১০টা পাতা আছে। বইয়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৬ ইঞ্চি, আর প্রস্থ প্রায় ২০ ইঞ্চি - মোটামুটি একটা ছোট টেবিলের মতো বড়। আর ওজন? প্রায় ৭৫ কেজি! এত ভারি যে একা কেউ বইটা বইতে পারবে না, আর চেষ্টা করলে নিজের আঘাতও লাগতে পারে।
বইয়ের শেষের কিছু পাতা আজ আর পাওয়া যায়নি। ইতিহাসবিদরা ভাবেন, হয়তো কেউ ইচ্ছা করেই সেগুলো ছেঁড়ে ফেলেছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় ও ভারি পাণ্ডুলিপি এই কোডেক্স গিগাসই!!
গল্পের সত্যতা যাচাই🔍
বিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষার মাধ্যমে কোডেক্স গিগাসের ইতিহাসের সত্যতা যাচাই করেছেন। প্রচলিত গল্প বলে, বইটি একরাত্রির মধ্যে লেখা হয়েছিলো। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এতে একমত নন। সুইডেনের জাতীয় গ্রন্থাগারের গবেষকরা বলছেন, যদি লেখক সপ্তাহজুড়ে প্রতিদিন প্রায় ৬ ঘণ্টা করে লিখতেন, তবুও শেষ করতে লাগত প্রায় ত্রিশ বছর! আর যেহেতু একজন সন্ন্যাসীর পক্ষে প্রতিদিন এতক্ষণ লেখা সম্ভব নয়, তাই সময়টা আরও বাড়তে পারে, বিশ থেকে ত্রিশ বছরের বেশি।
তাই বিজ্ঞান একদম নিশ্চিত, একরাত্রিতে এই বিশাল বই লেখা অসম্ভব। কিন্তু তারা হাতের লেখার পরীক্ষা করে এও নিশ্চিত যে, পুরো বইটি এক ব্যক্তির হাতেই লেখা!! বইয়ের বাইবেলের অংশে লাল, নীল, হলুদ আর সবুজ রঙের কালি ব্যবহার করা হয়েছে। ছবিগুলোতেও এই রঙগুলো দেখা যায়।
📖 বইয়ের বর্ণনা :
- পুরো পাণ্ডুলিপিতে মাত্র দু’টি ছবি অঙ্কিত হয়েছে - নরকের রাজপুত্র লুসিফার ও স্বর্গীয় শহর জেরুজালেম।
- লুসিফারের ছবি দেখা মাত্রই মনে হবে, যেন সে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে বই থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি আমাদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
- বইয়ের এক পৃষ্ঠায় চোর ধরার জন্য দুটি কার্যকরী জাদুমন্ত্রের বর্ণনা দেয়া আছে। চোর ধরতে ইচ্ছুক পাঠকরা তা গ্রহণ করতে পারেন, তবে অবশ্যই ল্যাটিন ভাষায় দক্ষ হতে হবে।
- শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য নানা অদ্ভুত ও রহস্যময় রীতিনীতি বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
- স্বর্গীয় শহরের ছবিতে কোনও মানুষের চিত্র নেই, শহরটি সম্পূর্ণরূপে জনমানবশূন্য হিসেবে উপস্থাপিত।
- লুসিফারের গায়ে মোটা উলের তৈরি রাজকীয় ‘আরমিন কোট’ পরিহিত ছিল, যা তাকে ‘নরকের রাজপুত্র’ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
বর্তমান অবস্থান
বইটি এখন সুইডেনের স্টকহোম শহরের National Library of Sweden-এ এই বই সংরক্ষিত আছে। ১৬৪৮ সালে ত্রিশ বছরের যুদ্ধে সুইডেন এই বইটি যুদ্ধলুট হিসেবে নিয়ে গিয়েছিল